আমাজন বন

আমরা যতই চাঁদ, মহাকাশ জয় করিনা কেন, পৃথিবীর অনেক রহস্যই আজো আমাদের অজানা রয়ে গেছে। আমাজন জঙ্গল এমনই একটি রহস্য। আমাজন জঙ্গল নিয়ে আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুব কমই আছে। আর আগ্রহ থাকবেই বা না কেন! এই পুরো জঙ্গলটাই তো একটা রহস্য আর বিষ্ময়ে ভরপুর।

আমাজনকে রেইনফরেস্ট  বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই না যে এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারনে। প্রচন্ড গরমের কারনে এখানে বাষ্পীভবনের হার অনেক বেশি যা আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারন।

আমাজান বন আমাজন নদীর অববাহিকায় পৃথিবীর সবচে বড় নিরক্ষীয় বন,যার আয়তন সাড়ে ৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার বা ৩.৪ মিলিয়ন বর্গ মাইল,পৃথিবী জুড়ে যে রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেকটাই হচ্ছে এই আমাজন বন

যদি এই রেইন ফরেস্টটি একটি দেশ হতো, তাহলে বিশালতার দিক থেকে এটি হতো বিশ্বের নবম বৃহত্তর দেশ। এই বন বাংলাদেশর তুলনায় ৩৮ গুন বড়। বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডকে ১৭ বার এই ফরেস্টে রাখা যাবে।দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে। 

আমাজন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগের ৯টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর ৬০ ভাগ ব্রাজিলে, ১৩ ভাগ পেরুতে এবং বাকি অংশ কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গুয়ানা, সুরিনাম এবং এবং ফরাসি গায়ানাতে অবস্থিত।

এ বনে রয়েছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট–পতঙ্গ, ১,২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ,আমাজনে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড় ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব–অণুজীব।

পাশাপাশি আমাজন নদীতে ৩০০০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী আছে।আমাজন জঙ্গলের পেরুর অংশে একটি মাত্র গাছে ৪৩ হাজার প্রজাতির পিপড়া পাওয়া গিয়েছে।বিশ্বে খাবারের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তার  ৮০ শতাংশই আসে আমাজন জঙ্গল থেকে। এছাড়া বর্তমানে যেসব ওষুধ তৈরি হয়, তার প্রায় ২৫ শতাংশ উপাদান আসে আমাজন থেকে।নানা রকম প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে সমৃদ্ধ এই আমাজন।এই বনে প্রায় ১৬০০০ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে।

পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে এলডোরাডো নামের এক গুপ্ত শহর। ধারণা করা হতো এই শহরটি পুরোটা স্বর্ণের। এই ভ্রান্ত ধারণাটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে।

সে গল্পে বলা হয়েছে, ‘এলডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় এক শ্রেণির বিশেষ নারী যোদ্ধারা। যাদের গল্পে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামে এই ‘এলডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পায়নি। শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় আমাজন জঙ্গল।


সম্প্র্রতি বিজ্ঞানীরা বলছেন  অ্যামাজনের গাছের প্রজাতির সংখ্যার তালিকা তৈরি করতে তিনশ বছর লেগে যাবে। এরই মধ্যে জাদুঘরে রাখা ৫ লাখেরও বেশি উদ্ভিদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির গাছের সংখ্যা আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও প্রায় চার হাজার বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিলতে পারে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত বনে। ।

অ্যামাজনে আছে মাংসখেকো গাছ। এই গাছের আঠায় প্রজাপতি, ফড়িংয়ের  মতো ছোট প্রাণীরা আটকে যায়। তখন গাছের পাতা ঢেকে গিলে নিতে শুরু করে।আমাজনে আছে ‘লবস্টার ফ্লাওয়ার’। এই ফুলটি লম্বায় দেড় থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।এর একেকটি পাতা ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এ ছাড়া অ্যামাজনে ৩ হাজারেরও বেশি প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। আছে রাবার গাছ। অ্যামাজন জঙ্গলের রাবার গাছগুলো একেকটা ১০ তলা বিল্ডিং এর সমান উঁচু হয়ে থাকে। চকো-বীন বা চকলেট উৎপাদনকারী গাছেরও ঠিকানা বনে।

 অ্যামাজনের গভীরে আছে কফি গাছ। দৈত্যাকার পদ্মফুলের দেখা মিলবে এখানে। ভিক্টোরিয়া অ্যামাজোনিকা অ্যামাজনের আরেক বিস্ময়। প্রায় ৩ ডায়ামিটারের এই পদ্মফুল শুধু এই বনেই গহিনেই দেখা মেলে।আছে ফুটন্ত গরম পানির নদী, বিষাক্ত ব্যাগ যার বিষ ১০ জন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে।আছে ভয়ংকর মানুষখেকো পিরানহা,

এই আমাজন বনের ভেতরেই আছে আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম আমাজন নদী। এর প্রায় ১,১০০টি উপনদী আছে যার মধ্যে ১৭টির দৈর্ঘ্য ১০০০ মাইলের বেশি। এ নদ আমাজন অঞ্চলের প্রাণিবৈচিত্র্যের প্রধান উৎস 

বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ মিঠাপানির যোগান দেয় এই নদী। যা মোট পরিমানের ২৫ শতাংশ প্রায়। দীর্ঘতম নদীর দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পানি বহন করে এই নদী। বলা হয়ে থাকে, যেখানে আমাজন নদীর পানি সাগরে মিলিত হয় সেখানে সাগরের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাগরের লবনাক্ত পানিও মিঠা পানি হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে এ নদের মুখ  প্রায় ৩০০ মাইল চওড়া থাকে।

এই বনে ৩০০শ এর বেশি উপজাতি বাস করে। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। এছাড়া তারা পর্তুগীজ, স্প্যানিস ভাষায়ও কথা বলে। এছাড়াও এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। এদের বহিঃবিশ্বের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।

গবেষকদের মতে, এই বন প্রতি বছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে ডাকা হয়। তবে স্থানীয় অনেক সংস্থার অভিযোগ, সরকারি আইন অমান্য করে ব্রাজিলে  বন উজাড়ের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির স্পেস এজেন্সির তথ্য মতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলের তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে বন উজাড়ের হার ৬৪ ভাগ বেশি। 

ফলাফল স্বরূপ এ বছরের প্রথমার্ধে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে অ্যামাজনের বন উজাড়ের হার ৫৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এদিকে ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট স্পেস রিসার্চের তথ্য মতে, গেল এপ্রিল মাসে প্রায় ৪০৫ বর্গকিলোমিটার বন নিঃশেষ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে যার পরিমাণ ছিল ২৪৮ বর্গকিলোমিটার। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে উজাড় হয়েছে ১ হাজার ২০২ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল।


YouTube Video Link 

রহস্যময় আমাজন বন | কি আছে এই আমাজনের গহীনে? Amazon: Largest Rainforest In The World |

No comments:

Post a Comment

পাপের শহর লাস ভেগাস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর হচ্ছে লাস ভেগাস। সারা বিশ্বে এটি প্রমোদ নগরী হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরকে মনোরঞ্জনের রাজধানীও...