রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

পৃথিবীতে যতগুলো রহস্যময় স্থান আছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল।সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথা। আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে কোন জাহাজ বা প্লেন গেলে নাকি আর ফিরে আসেনা, এখানে গেলে সবকিছু উধাও হয়ে যায় অথবা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।


বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কোথায়;

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভুজ একদম ঠিকঠাক আটলান্টিক মহাসাগরের কোথায় অবস্থিত তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। একদল মানুষের মতে, এই ত্রিভুজ এলাকাটির এক প্রান্ত হলো পুয়ের্তো রিকোয়, আরেক প্রান্তে আছে যুক্তরাষ্ট্রের বাহমা ও ফ্লোরিডার দক্ষিণাংশে, আর অন্য প্রান্তে হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ। কেউ কেউ আবার এসব জায়গার সাথে মেক্সিকো উপসাগরকেও যুক্ত করেন।তবে লিখিত বর্ণনায় যে সাধারণ অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে রয়েছে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডার দক্ষিণ সীমানা যেখান ঘটেছে অধিকাংশ দূর্ঘটনা।


কেমন করে আবিষ্কৃত হলো এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ? :

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বিষয়ে যারা লিখেছেন তাদের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম ১৪৯২ সালে এই ত্রিভুজ বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেন। তিনি লিখেছিলেন তার জাহাজের নাবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন।

১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স সর্বপ্রথম এ ত্রিভুজ নিয়ে খবরের কাগজে লিখেন। এর দু বছর পর ফেইট ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড “সী মিস্ট্রি এট আওয়ার ব্যাক ডোর” শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভূজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।

১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে ফ্লাইট নাইনটিন নিয়ে আমেরিকান লিজান ম্যগাজিনে লিখা হয়। বলা হয়ে থাকে এই ফ্লাইটের দলপতি কে নাকি বলতে শোনা গিয়েছে- "আমরা কোথায় আছি জানি না, সবুজ বর্ণের জল, কোথাও সাদা কিছু নেই"। এতেই প্রথম ফ্লাইট নাইনটিনকে কোন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর ভিনসেন্ট গডিস The Deadly Bermuda Triangle নামে আর এক কাহিনী লিখেন ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে।এই কাহিনীতে তিনিই প্রথম বারমুডা-ট্রায়াঙ্গেল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।এর উপর ভিত্তি করেই তিনি আরও বিস্তর বর্ণনা সহকারে লিখেন "ইনভিজিবল হরাইজন" (Invisible Horizons) নামের বই। এছাড়া আরও অনেকেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বই লিখেছেন। এরা সবাই ঘুরেফিরে এই এলাকায় যে অতি প্রাকৃতিক কোন কিছু অস্তিত্ব রয়েছে সেটাই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।


কেন এত রহস্যে মোরা এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ? :

যখনই কোন বিমান বা জাহাজ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ গিয়েছে , তখনই সে গুলো কিভাবে যেন হারিয়ে যায় কিংবা সেখান থেকে যদি ফিরেও আসে, তবুও মুখোমুখি হয় অদ্ভুত সব ঘটনার। কিছু ঘটনার কারনে এই রহস্য যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে।

মারি সেলেস্ত নামের একটি মালবাহী জাহাজ, ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর, নিউইয়র্ক বন্দর থেকে রওনা হয়। অনেকদিন হয়ে যাওয়ার পরও জাহাজটি যখন গন্তব্যে পৌঁছায়নি, তখন শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। অনেক চেষ্টার পর জাহাজটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় খুঁজে পাওয়া গেল ভাসমান অবস্থায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো জাহাজে সব মালপত্র, খাবার দাবার সবকিছু একদম অক্ষত ছিল, শুধুমাত্র ১১ জন কর্মী উধাও!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, মার্কিন সরকার ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্য ইউএসএস সাইক্লোপস নামক একটি জাহাজ পাঠায়। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে জাহাজটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাছে এসে কোন চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে যায় এর সাথে থাকা ৩০৬ জন ক্রু নিয়ে।ঠিক একই ভাবে একই জায়গা থেকে ১৯৪১ সালে গায়েব হয়ে যায় ইউএসএস প্রটিয়াস ও ইউএসএস নিরিয়াস নামের দুটি জাহাজ।

তবে জাহাজের ঘটনা গুলোর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো, মেরিন সালফার কুইন নামক জাহাজটির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি। ১৫ হাজার টন গলিত সালফার আর ৩৯ জন ক্রু নিয়ে ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে রওনা হয় জাহাজটি। ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখে জাহাজটি যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অবস্থান করছিল তখন হঠাৎ রেডিও ট্রানস্মিশন অফ হয়ে যায়, অথচ অফ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও কমান্ডার বলছিলেন “কত সুন্দর আবহাওয়া ! কী চমৎকারভাবে নেভিগেশন চলছে !” এর পরপরই হঠাৎ করেই ৬০০ ফুটের বিশাল আকৃতির জাহাজটি একেবারে গায়েব হয়ে যায়।

এ তো গেল জাহাজের কথা, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে আজ পর্যন্ত যা কিছু হারিয়ে গিয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে বিস্ময়কর ও আলোচিত হল “ফ্লাইট নাইনটিন” নামক পাঁচটি বিমানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে, ইউএস নেভির সেরা ৫ জন অ্যাভেঞ্জার বম্বার একটি প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য রওনা হয়। রেডিওতে পাইলট বেজের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বলছিলেন লেফটেন্যান্ট চার্লস টেলর। কিন্তু বিমান গুলো যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলএ অবস্থান করছিল তখন কথা বলার একপর্যায়ে, পুরো বাক্য শেষ করার আগেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সবকিছু, হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সব! সেই ৫ বিমানের সন্ধান আজও মেলেনি।


অবশেষে সমাধান হলো রহস্যের :

বারমুডা রহস্য উদঘাটন করার জন্য বিজ্ঞানীরা কম চেষ্টা করেননি বরং এখনও চলছে গবেষণা। প্রচুর গবেষণার পর ২০১৬ সালের ৪ মার্চ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে, যার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০০ টির মত জাহাজ আর ৭৫ টির মত বিমান নিখোঁজ হয়েছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে।

তবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন, এই সব ঘটনার পেছনে অতিপ্রাকৃতিক কোন কারণ নেই। বরং বৈরী আবহাওয়া, মানবঘটিত ভুল আর দুর্ভাগ্যের কারণে আসলে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। তারা যুক্তি দেখান যে, এই অঞ্চল আর দশটা সাধারণ দুর্ঘটনা প্রবণ অঞ্চলের থেকে আলাদা কিছু না।

সত্যি বলতে ইউরোপ, অ্যামেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চলাচলের জন্য, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পথেই পড়ে। তাই প্রতিদিনই অনেক জাহাজ আর বিমান কে ওই পথ পাড়ি দিতে হয়। আর বেশি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনার খবর গুলো একটু বেশিই শোনা যায়।

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় Larry kusche এর “The Bermuda Triangle Mystery : Solved “ বইটি। যুক্তিতে ভরপুর এই বইটিতে দেখানো হয়েছে যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বেশিরভাগ গল্পই ভুয়া এবং অতিরঞ্জিত। প্রমাণ সহকারে ল্যারি দেখান যে, বারমুডার বেশিরভাগ প্রচলিত দুর্ঘটনাই আসলে সেখানে নয় বরং অন্য কোথাও ঘটেছে। আর ট্রপিক্যাল সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলে জাহাজডুবি তো স্বাভাবিক ঘটনা।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের অনেকখানি কিনারা করা গেলেও, একে নিয়ে এখনও নতুন নতুন গুজব ছড়ানো বন্ধ হয়নি। হবেই বা কেন? সাহিত্য আর মিডিয়ার অর্থোপার্জনের অনেক বড় একটা পুঁজি এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। যেহেতু কিছু রহস্যের আজও সমাধান হয়নি, তাই এখনো একে নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।


YouTube Video Link 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আসল রহস্য !! বাস্তবে কি আছে এখানে? Mystery Behind The Bermuda Triangle.

No comments:

Post a Comment

পাপের শহর লাস ভেগাস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর হচ্ছে লাস ভেগাস। সারা বিশ্বে এটি প্রমোদ নগরী হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরকে মনোরঞ্জনের রাজধানীও...