শিল্প সাহিত্য ও ঐতিহ্যের নগরী হিসেবে খ্যাত ফ্রান্স। ফ্রান্সের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হচ্ছে প্যারিস।
প্যারিসের কথা শুনলেই সবার আগে মাথায় আসে আইফেল টাওয়ারের নাম। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা হচ্ছে বুর্জ খলিফা। আচ্ছা বলুন তো উনিশ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা কোনটি ছিল। উত্তর হচ্ছে আইফেল টাওয়ার।প্যারিসের ঐতিহ্যবাহী শেন নদীর পাড়ঘেষা চ্যাম্প ডি মার্সে তে অবস্থিত এই স্থাপনাটি।
আমাদের আজকের এই পর্ব আইফেল টাওয়ারকে নিয়ে। আজকে আপনাদের বলবো আইফেল টাওয়ারের ইতিহাস ও এর অজানা তথ্য,হতে পারে যা আপনি আগে কখনো শুনেননি।
১৮৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার যখন ফরাসী বিপ্লবের স্মৃতিকে একটি নিদর্শনে ধরে রাখার জন্যই আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এই টাওয়ার নির্মাণ কাজের জন্য বিখ্যাত সেতু প্রকৌশলী আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেলকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি পেটা লোহার দিয়ে ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট উঁচু এই মিনারটি নির্মাণ করেন। তার নামানুসারেই এই মিনারটির নাম রাখা হয় ‘আইফেল টাওয়ার’।এটি বানানোর জন্য মোট ৭৮ লাখ ফ্রাঙ্ক খরচ হয়েছিল,যার বড় অংশটা তিনি নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন৷ এমনকি সময়মত কাজ শেষ করার জন্য নিজের সম্পত্তি বন্ধকও রেখেছিলেন তিনি।
আইফেল টাওয়ার তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি, আর সবমিলিয়ে কাজ শেষ হয় ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে সর্বমোট ২ বছর ২ মাস ৫ দিন, এই টাওয়ার তৈরিতে করতে কাজ করেছেন ৩০০ জন শ্রমিক। তারা ১৮,০৩৮ টুকরো রড আয়রন ও ২৫ লাখ নাটবোল্ট সংযোজন করেন। নির্মাণ শেষে এর ওজন দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার টন এবং উচ্চতা ৯৮৪.২৫ ফুট।
আইফেল টাওয়ার দু’একর জমি জুড়ে স্থাপিত। টাওয়ারটির চৃড়া থেকে ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে ৭৫ কিলোমিটার দূর থেকে আইফেল টাওয়ারের চূড়া দেখা যায়। অবশ্য এতো উচূতে উঠতে হলে আপনাকে ১৬৬৫টি সিঁড়ি পার করতে হবে। উদ্বোধনের ২০ বছর পর্যন্ত এই আইফেল টাওয়ারই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা৷
শুরুতে আইফেল টাওয়ারকে মনে করা হতো শহরের সবচেয়ে খারাপ স্থাপনা। এবং এই টাউয়ার নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলনো হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে এই আইফেল টাওয়ারটাই শহরের প্রতীক হিসেবে জায়গা করে নেয়।
মোট ২০ হাজারটি বাল্ব,৩৩৬টি প্রজেক্টর আলোকিত করে রাখে এই টাওয়ারকে। আইফেল টাওয়ার সবচাইতে সুন্দর দেখায় রাতের বেলায়। তবে সারাত আয়ফেল টাওয়ার আলোকিত হয়ে থাকে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রতি ঘণ্টায় ১ বার ৫ মিনিটের জন্য ঝলমল আইফেল টাওয়ার যা চলে রাত ১ টা পর্যন্ত।
প্রতি ৭ বছর পর পর আইফেল টাওয়ারে রঙ করা হয়।এই রঙের কাজ চলে প্রায় আঠারো মাস ধরে, তবে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এই ১৮ মাসে একদিনের জন্যও জনসাধারণের জন্য বন্ধ থাকে না আইফেল টাওয়ার। ৬০ টন রং লাগে আইফেল টাওয়ারের জন্য। এ পর্যন্ত ১৮ বার আইফেল টাওয়ার রং করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আইফেল টাওয়ার রং করতে ব্যয় হয় প্রায় ৪ মিলিয়ন ইউরো।
১৯০৯ সালে এর চুড়ায় বসানো হয় একটি বেতার এন্টেনা। এতে টাওয়ারের উচ্চতা আরও ২০.৭৫ মিটার বা ৬৬ ফুট বেড়ে যায়। সেই থেকে আইফেল টাওয়ারকে Radio Transmision জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। পরে আইফেল টাওয়ারে একটি টিভি এন্টেনাও বসানো হয়েছে। বর্তমানে এই টাওয়ারে ১২০টি আ্যন্টেনা রয়েছে।
রড আয়রন দিয়ে নির্মিত হওয়ার কারণে টাওয়ারটির ধাতব পদার্থ বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়-ছোট হয়। উষ্ণতার কারণে গ্রীষ্মকালে এর দৈর্ঘ্য বৃ্দ্ধি পায়। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপমাত্রা বাড়লে এর আকার বেড়ে যায় প্রায় ৬.৭৫ ইঞ্চি। ঝড়ো হাওয়ায় এটি সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কাঁপতে পারে!
টাওয়ারটির ভেতরে অবস্থিত দুটি রেস্তোঁরা হলো লা 58 ট্যুর আইফেল এবং লা জুল ভার্ন।এখানে একটি সংবাদপত্র অফিস আছে। এছাড়াও এতে রয়েছে পোস্ট অফিস, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও একটা থিয়েটার।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এ টাওয়ারটি বেতার তরঙ্গ সম্প্রচার করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্যারিসে নাৎসি বাহিনীর আগমনের আগে এর লিফটের তার কেটে দিয়েছিল মিত্র বাহিনী। নাৎসিরা যেন টাওয়ারটি ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
যে আইফেল টাওয়ার নির্মান করা হয়েছিল মাত্র ২০ বছরের জন্য,যে আইফেল টাওয়ার নির্মাণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছিল,সেই আইফেল টাওয়ার আজকে বিশ্ব সেরা স্থানগুলোর একটি।প্রতিবছর এই টাওয়ার দেখতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ আসে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ১৮৮৯ সাল থেকে এখন অবধি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পর্যটক আইফেল টাওয়ারে এসেছেন। ১৯৯১ইউনাস্কো আয়ফেল টাউয়ারকে বিশ্ব ঐতৈহ্যের স্থান হিসেবে সিক্রৃতি দেয়।
বর্তমান বিশ্বে আইফেল টাওয়ারের থেকে উঁচু টাওয়ার বা স্থাপনা অনেক রয়েছে। তবে আইফেল টাওয়ার এখনো পৃথিবীর সেরা স্হাপনা হিসেবে ধরা হয় এর নিজস্ব ইতিহাস ও বৈচিত্র্যে কারণে। আর তাই বিশ্ব মানচিত্রে আইফেল টাওয়ার এখনও অনন্য।
No comments:
Post a Comment