পবিত্র কাবা শরিফের ইতিহাস

সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান  মসজিদুল হারাম।এই মসজিদের কেন্দ্রেই রয়েছে পবিত্র কাবা শরিফ। কাবা শরিফ মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যেদিকে মুখ করে মুসলিমরা সালাত আদায় করে। হজ বা উমরা পালনের সময় মুসলমানরা কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ করে।

মসজিদুল হারাম, মক্কার হারাম এলাকায় কাবাঘরকে কেন্দ্র করে নির্মিত মসজিদ। এই এলাকাকে হারাম বলার কারণ হচ্ছে, ইসলাম আগমনের অনেক বছর আগে থেকেই এই এলাকায় হত্যাসহ যেকোন অপকর্ম নিষিদ্ধ ছিল।


হারাম এলাকার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদুল হারাম, আর এই মসজিদের কেন্দ্রস্থলে কালো বর্ণের ঘরটিই হলো কাবা শরীফ শরিফ বা মহান আল্লাহর সম্মানিত কাবাঘর।


পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। কাবাঘরকে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরানের ৯৬ নাম্বার আয়াতে বলেন, “নিশ্চই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদত রূপে নিরূপিত হয়েছে, তা ঐ ঘর যা মক্কাতে অবস্থিত”।

এরপর হযরত আদম (আঃ) আল্লাহ তায়ালার আদেশে কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণ করেন।

হজরত নূহ (আ.)-এর সময় সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুনরায় কাবাঘর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ) কাবার পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ পাথর স্থাপন করেছিলেন, যা হাদিস অনুযায়ী বেহেশত থেকে আগত। এই পাথর একসময় দুধের মত সাদা ছিল কিন্তু মানুষের গুনাহ শোষণ করার কারণে এটি কালো হয়ে গিয়েছে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশ। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জীবিত অবস্থায় ৬ হিজরীতে আব্দুলাহ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) কাবা শরীফ সংস্কার করেন। এরপর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭৪ হিজরীতে কাবা শরীফ সংস্কার করেন।

৪১৬ হিজরিতে বাদশাহ ফাহদ কাবার বাইরের দেয়াল সংস্কার করেন। ১৪১৭ হিজরিতে তিনি কাবাগৃহের ছাদ, খুঁটি, দেয়ালসহ সব কিছু সংস্কার করে নতুন ধাঁচে ঢেলে সাজান। 

এর পর থেকে নির্মাণের পরিবর্তে কাবা শরিফের সংস্কারকাজ অব্যাহত রয়েছে। ৯১ হিজরিতে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক কাবাগৃহে ব্যাপক সংস্কার করেন।তাঁর এ নির্মাণকাজকে কাবার সর্বশেষ নির্মাণ বা সর্বশেষ সংস্কার হিসেবে অভিহিত করা হয়। এযাৎ কাবা শরিফ ১২ বার সংস্কার করা হয়েছে। 

সৌদি গেজেট মতে, কাবাগৃহের উচ্চতা পূর্ব দিক থেকে ১৪ মিটার।  পশ্চিম দিক থেকে ১২.১১ মিটার। উত্তর দিক থেকে ১১.২৮ মিটার। দক্ষিণ দিক থেকেও ১২.১১ মিটার।

ভূমি থেকে কাবার দরজার উচ্চতা ২.৫ মিটার। দরজার দৈর্ঘ্য ৩.০৬ ও প্রস্থ ১.৬৮ মিটার। বর্তমান দরজা বাদশা খালেদের উপহার, যা নির্মাণে প্রায় ২৮০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। 

কাবা শরীফের সিলিংকে তিনটি কাঠের পিলার ধরে রেখেছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.। 

পিলারের কাঠগুলো এতই শক্ত প্রকৃতির যে, এর মতো বিকল্প কাঠ পাওয়া যায় না। এগুলো প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর (রা:) স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে এ কাঠনির্মিত খুটির বয়স ১ হাজার ৩৫০ বছর।

কাবা শরিফের ভেতরের দেয়ালগুলো সবুজ ভেলভেটের পর্দা দিয়ে আবৃত। এই পর্দাগুলো প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করা হয়।

কাবা ঘরের গিলাফের রঙ কখনোই কালো ছিল না। বর্তমানে কাবা ঘরের গিলাফের রঙ কালো ব্যবহার করা হয়। আব্বাসীয় খলিফাদের পরিবারের প্রিয় রঙ ছিল কালো। তাদের সময় থেকে কাবা ঘরে কালো গিলাফ পরানো হয়। এর আগে কাবা ঘরে সবুজ, লাল ও সাদা রঙের গিলাফ ব্যবহার করা হতো।

কাবা ঘরের ভেতরে যে কোনো দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করা যায়। তাতে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।আবার কাবা ঘরের বাইরে যে কোনো পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া যায়।

দেয়ালের ওপরের অংশে রয়েছে সাঁটানো সবুজ রেশমি কাপড়। তাতে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত স্বর্ণখচিত করে অঙ্কিত। বছরে দুইবার কাবাঘর পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত হয় জমজমের পানি, খাঁটি গোলাপ জল এবং উন্নত মানের সুগন্ধি উদ। কাবার গিলাফ তৈরি করা হয় ৬৭০ কেজি রেশম দিয়ে। গিলাফের ওপর দিকে সোনার প্রলেপকৃত রুপার চিকন তার দিয়ে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফিখচিত করা।

 মোট পাঁচ টুকরা গিলাফ বানানো হয়। চার টুকরা চারদিকে এবং পঞ্চম টুকরাটি কাবার দরজায় লাগানো হয়। টুকরাগুলো মজবুতভাবে সেলাইযুক্ত। 

মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা ঘরের চাবি বনি শায়বাহ গোত্রের ওসমান ইবনে তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে হস্তান্তর করেন। বংশ পরম্পরায় এখনো তারাই কাবা ঘরের চাবির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

কাবাঘরের ৪টি কোণের আলাদা নাম আছে

(১) হাজরে আসওয়াদ (২) রুকনে ইরাকী (৩) রুকনে শামী ও (৪) রুকনে ইয়ামেনী।


১৯৪১ সালে সপ্তাহব্যাপী প্রবল বৃষ্টির কারণে কাবা চত্বরসহ মক্কার বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। আর সে সময় কাবা ঘর জিয়ারতকারীদের কেউ কেউ সাঁতার কেটে কাবা ঘর তাওয়াফ করেন। সেসময় সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির কারণে কাবা চত্বরে প্রায় ৬ ফট পানি জমে যায়।

কাবা ঘরের পাশেই আছে মাকামে ইব্রাহিম নামের একটি অলৌকিক পাথর। কাবা শরিফের পূর্ব-উত্তর পাশে সোনালি বেষ্টনীতে পায়ের ছাপযুক্ত যে পাথরখণ্ডটি সংরক্ষিত রয়েছে তা হলো মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম অর্থ স্থান বা দাঁড়ানোর জায়গা। এ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন

বেহেশতি একটি পাথর হলো হাজরে আসওয়াদ। আসওয়াদ মানে কালো, হাজর মানে পাথর। এই কালো পাথরটি হজরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। বর্তমানে এটি ছোট ছোট ১২টি খণ্ডে বিভক্ত, এর ৮ টুকরা দৃশ্যমান। বর্ণিত আছে, এটি কিয়ামতের দিন তাকে স্পর্শকারী বা চুম্বনকারীর পক্ষে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। 

অনেকদিন ধরেই কাবা ঘরের বিভিন্ন ধরনের বিশেষ তালা ও চাবির ব্যবহার হয়ে আসছে। দীর্ঘ দিন পরপর পরিবর্তন করা এসব তালা কিংবা চাবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত কাবা শরিফে ৫৮টি তালা-চাবির নিবন্ধনের তথ্য পাওয়া যায়।যার মধ্যে তুরস্কের সাবেক রাজধানী ও প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুলে তোপকাপি জাদুঘরেই রয়েছে ৫৪টি চাবি।

প্রথমে কাবা শরিফ কিবলা ছিল না। বরং প্রথম কিবলা ছিল জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা। মদীনায় হিজরতের ষোল মাস পর কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী কিবলা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের কিবলা অর্থাৎ কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়।

কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সৌদি রাজপরিবারের। সৌদি সরকারের প্রধান (বাদশাহ) কাবা শরীফের মোতায়াল্লির দায়িত্বে থাকেন


YouTube Video Link

পবিত্র কাবা : ইতিহাস ও অজানা তথ্য |

No comments:

Post a Comment

পাপের শহর লাস ভেগাস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর হচ্ছে লাস ভেগাস। সারা বিশ্বে এটি প্রমোদ নগরী হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরকে মনোরঞ্জনের রাজধানীও...